বাংলার সুলতান জালালুদ্দিন মুহম্মদ শাহ
বাংলার সুলতানদের অধীনস্থ একজন উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলো গণেশ ছিলেন। রাজা গণেশ ছিলো বাংলার সুলতানের অধীনস্থ উত্তর বঙ্গের ভাদুড়িয়ার (বর্তমাম দিনাজপুর অঞ্চল) একজন প্রভাবশালী জমিদার। রাজা গণেশ বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের সময় থেকেই নিজের শক্তি ও লোকবল বৃদ্ধি করার মাধ্যমে ধীরে ধীরে নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি শুরু করেন এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সাম্রাজ্যে চরম অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে থাকেন। ধারণা করা হয় যে, গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের মৃত্যুর পেছনে রাজা গণেশের হাত ছিলো। গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সিংহাসনে বসেন ; কিন্তু সকল ক্ষমতা চলে যায় রাজা গণেশের হাতে, বাংলার সুলতান তখন নামেমাত্র সম্রাটে পরিণত হন। রাজা গণেশ রাজ্যে চরম অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে থাকেন। একসময় রাজা গণেশ তার অনুগত ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতানের একজন দাসকে দিয়ে ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতান কে হত্যা করেন এবং সেই দাসকে ক্ষমতায় বসান। সেই দাস শিহাবউদ্দিন বায়াজিদ শাহ হিসেবে সিংহাসনে বসেন। কার্যত বাংলার ক্ষমতা তখন রাজা গণেশের কুক্ষিগত। একপর্যায়ে গণেশ শিহাবউদ্দিন বায়াজিদ শাহ কেও হত্যা করে নিজে বাংলার মসনদ দখল করেন।
রাজা গণেশ বাংলার ক্ষমতা দখল করে ইসলামি সালতানাতের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন এবং বাংলা কে হিন্দু সাম্রাজ্য ঘোষণা করেন। তিনি বাংলার মুসলিমদের উপর অকথ্য শোষণ, নিপীড়ন ও অত্যাচার করা শুরু করেন। বহু মসজিদকে মন্দিরে পরিণত করেন, অসংখ্য মসজিদ, মাজার, ইসলামি ইমারত ধ্বংস করেন। এমনকি তিনি রাজধানীর প্রধান মসজিদটি কেও দখল করেন। বাংলার সুলতানদের শাসনামলে হিন্দুদের পূজা-পার্বণ-সাহিত্যচর্চা কোনো কিছুতে বাধা প্রদান করা না হলেও রাজা গণেশ প্রকাশ্যে আজান দেয়া, নামাজ পড়া নিষিদ্ধ করেন। সূফী সাধক দের উপর অকথ্য অত্যাচার শুরু করে এক কুখ্যাত গণেশ। রাজধানীর সকল শিক্ষিত মুসলিম কে নদীতে নৌকা ডুবিয়ে হত্যা করে রাজা গণেশ। সে মহারাজ গণেশ নারায়ণ রায় ভাদুড়ি উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে বসেন ও নিজে ‘দনুজবর্মণ দেব’ (এ থেকেই দিনাজপুর নামটি এসেছে বলে ধারণা করা হয়) উপাধি ধারণ করেন। রাজা গণেশ সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের বিধবা স্ত্রী ফুলজানি কে জোর করে বিয়ে করে ও দিনের পর দিন ধর্ষণ করতে থাকে । সে অসংখ্য মুসলিম নারী কে নিজের রক্ষিতায় পরিণত করে।
এভাবে বাঙালি মুসলমানের উপর চরমপন্থী অত্যাচারী সাম্প্রদায়িক রাজা গণেশের অকথ্য অত্যাচার যখন বৃদ্ধি পাচ্ছিলো,
তখন দরবেশ শেখ নূর কুতুব উল-আলম জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কী কে বাংলার মুসলিমদের রক্ষার্থে বাংলা আক্রমণের আহ্বান জানান। জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কী বিরাট বাহিনী নিয়ে বাংলা আক্রমণ করেন। এতো বিশাল বাহিনীকে প্রতিরোধ করার মতো শক্তি রাজা গণেশের ছিলো না। তখন গণেশ ভীত হয়ে ইব্রাহিম শর্কীর সাথে সমঝোতা করতে চায়। ইব্রাহিম শর্কী সমঝোতা হিসেবে গণেশকে ইসলাম গ্রহণ করতে বলে। কিন্তু রাজা গণেশ ছিলো এক চরমপন্থী উগ্র ব্রাহ্মণ ; ইসলাম গ্রহণ করতে তাই সে অস্বীকৃতি জানায়। শেষে সমঝোতা হিসেবে রাজা গণেশের বড় ছেলে রাজপুত্র যদুনারায়ণ ইসলাম গ্রহণ করেন এবং সুলতান জালালুদ্দিন মুহম্মদ শাহ নাম ধারণ করে বাংলার সিংহাসনে বসেন এবং গণেশ সিংহাসন থেকে সরে দাঁড়ান।
এক বছরের মাথায় ইব্রাহিম শর্কীর মৃত্যু হলে রাজা গণেশের সামনে আর কোনো প্রতিরোধ থাকে না। তিনি তার ছেলে জালালুদ্দিনকে সিংহাসন থেকে নামিয়ে নিযে সিংহাসনে আরোহণ করে এবং মুসলমানদের উপর পুনরায় অত্যাচার শুরু করে। জালালুদ্দিন কে পুনরায় ‘সুবর্ণধেনু’ যজ্ঞের মাধ্যমে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়। এই যজ্ঞের নিয়মানুসারে একটি স্বর্ণের গাভী তৈরি করে সেই গাভীর মুখ দিয়ে যদু (জালালুদ্দিন) কে ঢুকিয়ে পশ্চাৎদেশ দিয়ে বের করে আনা হয়। এরপর স্বর্ণসমূহ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে দেয়া হয়। এটি ছিলো ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু পণ্ডিতদের অর্থসিদ্ধির একটি হাতিয়ার মাত্র। হিন্দু পণ্ডিতদের এই নীচ ঘটনা প্রত্যক্ষ করে যদুর মনে হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে ব্যাপক বিতৃষ্ণা শুরু হয়। তিনি ইসলাম সম্পর্কে বেশি বেশি জানার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং সূফী সাধকদের সংস্পর্শে এসে ইসলাম সম্পর্কে অধিক জ্ঞানার্জন করে ইসলাম গ্রহণের জন্য নিজের মনস্থির করেন। তিনি ইসলাম কে পৃথিবীর একক পরম সত্য ধর্ম হিসেবে জ্ঞান করেন এবং পুনরায় ইসলাম গ্রহণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
এছাড়া,,, যদু সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের কন্যা শাহজাদি আসমানতারার প্রেমে পড়েন। তিনি আসমানতারাকে অনেক ভালোবাসতেন, যা তাকে ইসলাম গ্রহণের দিকে আরও অধিক ধাবিত করেছিলো।
যদুর ইসলাম গ্রহণের প্রবল ইচ্ছার কথা জানতে পেরে রাজা গণেশ শঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং হিন্দু পণ্ডিতদের পরামর্শে তাঁকে বন্দি করেন। যদু কারাবন্দি অবস্থাতেই অত্যাচারী সাম্প্রদায়িক শাসক রাজা গনেশকে উৎখাত করবার পরিকল্পনা করেন এবং বাংলার ইসলাম ও মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষার লক্ষ্য নিয়ে যদু তাঁর পরিকল্পনা অনুসারে গুপ্তঘাতক পাঠিয়ে পিতা রাজা গণেশকে হত্যা করেন। এরপর তার ছোটভাই মাহেন্দ্রদেব সিংহাসনে বসলেও তাকেও তিনি হত্যা করে পুনরায় ইসলাম গ্রহণ করে সুলতান জালালউদ্দিন মুহম্মদ শাহ উপাধি নিয়ে ১৪১৮ সালে বাংলা সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন।
তিনি তাঁর সাফল্যমণ্ডিত শাসনামলে বাংলায় ইসলাম প্রচারে ও বাংলার রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বৃদ্ধিতে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। ১২০৪ সালে তুর্কি বংশোদ্ভুত সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির নদীয়া (১২০৫ সালে লক্ষ্মণাবতী) বিজয়ের মাধ্যমে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূত্রপাত হলেও সুলতান জালালুদ্দিন মুহম্মদ শাহ এর পূর্ববর্তী কোনো শাসক-ই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ইসলাম প্রচার শুরু করেন নি ; এই কাজটি শুরু করেন সুলতান জালালুদ্দিন মুহম্মদ শাহ। তিনি ইসলাম কে রাজধর্মের মর্যাদা প্রদান করেন ও ইসলামের প্রসারে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। তিনি তাঁর বাবা রাজা গণেশ কর্তৃক ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদ ও ইসলামি স্থাপত্যসমূহ পুনর্নির্মাণ করেন। তিনি অসংখ্য মসজিদ, মাজার, খানকা ও স্থাপত্য নির্মাণ করেন এবং সূফী দরবেশদের বিশেষ রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন। অর্থলিপ্সু উগ্র ব্রাহ্মণদের সাথে তাঁর পুরনো হিসেব চুকানো বাকি ছিলো। সাম্প্রদায়িক অত্যাচারী গণেশের সহায়তাকারী সেই উগ্র ব্রাহ্মণ্যবাদীদের সুলতান জালালুদ্দিন মুহম্মদ শাহ শাস্তি হিসেবে গরুর মাংস খাইয়ে দেন।
তিনি তাঁর শাসনামলে আরাকান কে বাংলা সালতানাতের ভাসাল স্টে টে পরিণত করেন। আরাকানের রাজারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও বাংলার সুলতানের প্রতি আনুগত্যের নিদর্শনস্বরূপ তারা ইসলামি নাম গ্রহণ করতেন। এসময়ই আরাকানে ইসলামের ব্যাপক বিস্তারের পথ সুগম হয়। তিনি গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের কন্যা শাহজাদি আসমানতারা কে বিবাহ করেন। জালালুদ্দিন তাঁর শাসনামলে চীনের মিং রাজবংশ, তিব্বতি সাম্রাজ্য, তৈমুরি সাম্রাজ্য ও মামলুক সালতানাতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তাঁর শাসনামলের শেষদিকে তিনি কায়রোর আব্বাসীয় খলিফার থেকে নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করেন এবং নিজেকে ‘খলিফাতুল্লাহ’ (আল্লাহর খলিফা) ঘোষণা করেন।
১৪৩৩ সালে বাংলার খলিফাতুল্লাহ সুলতান জালালুদ্দিন মুহম্মদ শাহ মহান প্রতিপালকের ডাকে সাড়া দিয়ে পরলোক গমন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শামসউদ্দিন সিংহাসনে আরোহণ করেন।
সুলতান জালালুদ্দিন মুহম্মদ শাহের দৃঢ় ইমান, সাহসিকতা, প্রজ্ঞা ও কূটনৈতিক দক্ষতার ফলশ্রুতিতেই চরমপন্থী হিন্দুত্ববাদী শাসন থেকে রক্ষা পেয়েছিলো বাংলা, বাংলার মাটিতে আবারো ধ্বনিত হয়েছিলো আজানের সুমধুর সুর। বাঙালি মুসলমানের ক্রান্তিলগ্নেত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন সুলতান জালালুদ্দিন মুহম্মদ শাহ।
আল্লাহ ইসলামের এই বীর সিপাহসালার কে জান্নাতবাসী করুন।
লেখা :- রাজিত তাহমীদ জিত
সোর্সঃ
১।রিয়াজ আস-সালাতিন – গোলাম হোসেন সলিম
২।বাংলার ইতিহাস সুলতানী আমল – প্রফেসর আব্দুল করিল
৩। আমার সোনার বাংলাদেশ – মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
৪। সোশ্যাল হিস্টোরি অব দ্যা মুসলিমস ইন বেঙ্গল – প্রফেসর আব্দুল করিম
৫। এই আমাদের বাংলাদেশ – সুব্রত বড়ুয়া
৫। উইকিপিডিয়া